সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে শীতের হিমেল শুভেচ্ছা। শীতের গরম ভাঁপা পিঠা আর খেজুরের রসের পায়েস দিয়ে শুরু হয় আমাদের গ্রামবাংলার সকাল। আর সারা বাংলার বাজারগুলোতে দেখা য়ায় বিভিন্ন ধরনের সবজি। শীতকাল কৃষির একটি ব্যস্ততম মৌসুম। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই পৌষ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোনো কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
ফসল / অবস্থা/বিবরণ / করণীয়
বোরো ধান
বীজতলার যত্ন
শীতকালে বোরো ধানের বীজতলায় চারার যত্ন নিতে হবে। বিশেষ করে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় যাতে চারাগুলোর বাড়বাড়তি ঠিকমতো হয় সেজন্য চারার বৃদ্ধির বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
এ সময় স্বল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার এবং জিপসাম সার বীজতলায় প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। এছাড়া শুষ্ক বীজতলার মাধ্যমে চারা উৎপাদন করলে শীতের প্রকোপ থেকে চারাকে রক্ষা করা যায়। শুষ্ক বীজতলায় চারার বাড়বাড়তিও ভালো হয়। আর লবণাক্ত প্রবণ এলাকায় ব্রি ধান৪৭ এবং ব্রি ধান৬১ চাষাবাদ করা দরকার। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে যেমন ধানের ফলন বাড়ানো যায় তেমনি খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করাও সম্ভব হয়।
জমিতে চারা রোপণ
চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে চারা রোপণ শুরু করতে পারেন। এজন্য জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে পানিসহ কাদা করতে হবে। চাষের আগে জমিতে জৈব সার দিতে হবে এবং শেষ চাষের আগে দিতে হবে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার। ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৫০-৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বীজতলা থেকে সাবধানে চারা তুলে এনে মূল জমিতে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার এবং গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫ সেন্টিমিটার বজায় রেখে প্রতি গোছায় ২-৩টি সুস্থ চারা রোপণ করলে ফলন ভালো হয়।
গম
সার প্রয়োগ ও সেচ প্রদান
গমের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সেচ দেয়ার উপযুক্ত সময় এখন। চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে গম ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে এবং সেচ দিতে হবে। সেচ দেয়ার পর জমিতে জো আসলে মাটির উপর চটা ভেঙে দিতে হবে। তাছাড়া গমের জমিতে যেখানে ঘন চারা রয়েছে সেখানে কিছু চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে।
ভুট্টা
আন্তঃপরিচর্যা
ভুট্টা ক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর সেচ প্রদান করতে হবে এবং গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দিতে হবে। ভুট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
আলু
সার প্রয়োগ ও
চারা গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হলে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। দুই সারের মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে গাছ হেলে পড়রে এবং ফলন কমে যাবে।
পরিচর্যা
আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে স্প্রেয়িং শিডিউল মেনে চলতে হবে। তবে বালাইনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা দরকার। এছাড়া বালাইনাশক কেনার আগে তা ভালোমানের কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। মড়ক রোগ দমনে দেরি না করে ২ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে। আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে দিতে হবে এবং ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুলা
সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
এ সময় তুলা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে হবে। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে। রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা উঠাতে হয়। ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ভালো তুলার সাথে যেন খারাপ তুলা (পোকায় খাওয়া, রোগাক্রান্ত) কখনো না মেশে।
ডাল ও তেল ফসল
সংগ্রহ
মসুর, ছোলা, মটর, মাসকালাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন। সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। এত জমিতে উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।
শাকসবজি
পরিচর্যা
শীতকাল শাকসবজির মৌসুম। নিয়মিত পরিচর্যা করলে শাকসবজির ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া , মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যতœ নিতে হবে। টমেটো ফসলের মারাত্মক পোকা হলো ফলছিদ্রকারী পোকা। এ পোকার আক্রমণে ফলের বৃন্তে একটি ক্ষুদ্র আংশিক বদ্ধ কালচে ছিদ্র দেখা যাবে। ক্ষত্রিগ্রস্ত ফলের ভেতরে পোকার বিষ্ঠা ও পচন দেখা যাবে। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ মথকে ধরে সহজে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতি বিঘা জমির জন্য ১৫টি ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। আধাভাঙা নিম বীজের নির্যাস (৫০ গ্রাম এক লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১২ ঘণ্টা ভেজাতে হবে এবং পরবর্তীতে মিশ্রণটি ভালো করে ছাকতে হবে) ১০ দিন পর পর ২/৩ বার স্প্রে করে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস গ্রুপের কীটনাশক (দেবীকইন ২৫ ইসি/কিনালাক্স ২৫ ইসি/করোলাক্স ২৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। এ সময় চাষিভাইরা টমেটো সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে পারেন। আধা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠাণ্ডা জায়গায় উপুড় করে ঝুলিয়ে টমেটোগুলোকে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। পরবর্তীতে ৪-৫ মাস পর্যন্ত অনায়াসে টমেটো খেতে পারবেন। আর শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ দিতে হবে। তাছাড়া আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, সারের উপরিপ্রয়োগ ও রোগবালাই প্রতিরোধ করা জরুরি।
গাছপালা
পরিচর্যা
গত বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা কাঠ গাছের যত্ন নিতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। রোগাক্রান্ত হাছের আক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে। এ সময় গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির যত্ন
শীতকালে পোলট্রিতে যে সব সমস্যা দেখা যায় তা হলো-অপুষ্টি, রানীক্ষেত, মাইকোপাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা। মোরগ-মুরগির অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানে ভিটামিন এ, সি, ডি, ই, কে ও ফলিক এসিড সরবরাহ করতে হবে। তবে সেটি অবশ্যই প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে, নাহলে অনেক সময় মাত্রা না জেনে ওষুধ বা ভিটামিন প্রয়োগে ক্ষতির আশংকা থাকে। এছাড়া খরচও বেড়ে যায় । শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোলট্রি শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে অনেকেই হাঁস পালন করে থাকেন। এ সময় হাঁসের যেসব রোগ হয় সেগুলো হলো- হাঁসের প্লেগ রোগ, কলেরা রোগ এবং বটুলিজম। প্লেগ রোগ প্রতিরোধে ১৮-২১ দিন বয়সে প্রথম মাত্রা এবং প্রথম টিকা দেয়ার পর ৩৬-৪৩ দিন বয়সে দ্বিতীয় মাত্রা পরবর্তী ৪-৫ মাস পরপর একবার ডাক প্লেগ টিকা দিতে হবে।
গরু-বাছুরের যত্ন
গাভীর জন্য শীতকালে মোটা চটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। নাহলে গাভীগুলো তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে যাবে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সারা বছরের টিকা প্রদান এবং পরিচর্যা বিষয়ক পরিকল্পনা ও করণীয় কি সেসব বিষয়ে লিখিত পরামর্শ গ্রহণ করে তা মেনে চলতে হবে। তাছাড়া গাভীর খাবার প্রদানে যেসব বিষয়ে নজর দিতে হবে তাহলো- সঠিক সময়ে খাদ্য প্রদান, গোসল করানো, থাকার স্থান পরিষ্কার করা, খাদ্য সরবরাহের আগে খাদ্য পাত্র পরিষ্কার করা এবং নিয়মিত প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। তবে গাভীর খাবারের খরচ কমাতে সবচেয়ে ভালো হয় নিজেদের জমিতে তা চাষাবাদ করা। আর একটি কাজ করলে ভালো হয় সেটি হলো-সমবায় সমিতি করে ওষুধ ও চিকিৎসা করানো। এতে লাভ হয় বেশি। খরচ যায় কমে।
শীতকালে ছাগলের নিউমোনিয়া রোগটি খুব বেশি হয়। এ রোগে ফুসফুস আক্রান্ত হয়, এতে বারবার ব্যথাযুক্ত কাশি হয়ে থাকে। প্রায় সব বয়সের ছাগলে এ রোগটি হয়ে থাকে। তবে ১ দিন থেকে ৩ মাস বয়সের ছাগলের বাচ্চার এ রোগটি বেশি হয়। এ রোগ হলে প্রথমে অল্প অল্প জ্বর হবে কিন্তু সব সময় নয়। ছাগল বারবার হাঁচি ও কাশি দেবে, কাশির সময় পাঁজর ওঠানামা করবে । শ্বাস নেয়ার সময় কষ্ট হবে। এ সময় ছাগল খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দেয়, নাক ও মুখ দিয়ে সর্দি ও কাশি বের হয় এবং এক পর্যায়ে ১০৪-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর হবে। যদি ৫ দিনের বেশি কাশি ও দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা হয় তবে বুঝতে হবে প্যারাসাইট এর জন্য নিউমোনিয়া হয়েছে। নিউমোনিয়াতে সেফটিয়াক্সোন ও টাইলোসিন ব্যবহারে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়াও পেনিসিলিন, অ্যামপিসিলিন, অ্যামোক্সিসিলিন, স্টেপটোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন ব্যবহারেও ভালো সাড়া পাওয়া যায়।
মৎস্যসম্পদ
মাছের যত্ন
শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার। কারণ এ সময়ে পুকুরে পানি কমে যায়। পানি দূষিত হয়। মাছের রোগবালাইও বেড়ে যায়। সে কারণে কার্প ও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি বা উদর ফোলা রোগ বেশি হয়। আর এ রোগটি বড় মাছে বেশি হয়। এ রোগের লক্ষণগুলো হলো-দেহের ভেতর হলুদ বা সবুজ তরল পদার্থ জমা হওয়া; পেট খুব বেশি ফুলে যাওয়া। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা। তরল পিচ্ছিল পদার্থ বের হওয়া। মাছ উল্টা হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। খাবার গ্রহণে অনীহা হয়। আর এ রোগের প্রতিকারে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পর পর ৭ দিন খাওয়াতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় এ বিষয়ে আপনার কাছের উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ গ্রহণ করা।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম হলেও শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই যদি প্রতি ফসলে চাহিদা মাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে দেখবেন আপনার জমির ফলন কতখানি বাড়ে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সবক’টি কৌশল যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারব। আপনাদের সবার জন্য নিরন্তন শুভ কামনা। কৃষির সমৃদ্ধিতে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫